ঝরাপালক
বনফুল
পূরবী
শ্যামলী
প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার। প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম ‘বীরবল’। প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের যশোরে জন্মগ্রহণ করেন তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার অন্তর্গত চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক হিসাবে পরিচিত। সবুজপত্র পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে চলিতরীতি প্রবর্তন করেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন প্রমথ চৌধুরী। ছোটোগল্প ও সনেট রচনাতেও হিসেবেও তার বিশিষ্ট অবদান রয়েছে।
প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদিত পত্রিকা সবুজপত্র এবং
বিশ্বভারতী পত্রিকা। তিনি ছিলেন বাংলা রেনেসাঁর সাহিত্যিক।
প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন
শিক্ষাজীবনে প্রমথ চৌধুরী ছিলেন অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ এ পাস করেন।
প্রমথ চৌধুরী প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯ সালে দর্শনে বিএ (অনার্স) এবং ১৮৯০ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান।
বিলাত থেকে ফিরে এসে ব্যারিস্টারি পেশায় যোগদান না করে তিনি কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন এবং পরে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী পদক’ লাভ করেন ।
পারিবারিক ও কর্মজীবনে প্রমথ চৌধুরী
প্রমথ চৌধুরী কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে আইনব্যবসা করেন। কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে পড়িয়েছেন। তিনি ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪২-১৯২৩) কন্যা ইন্দিরা দেবীর (১৮৭৩-১৯৬০) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সে হিসেবে প্রমথ চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি জামাতা। লেখক আশুতোষ চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪৪) সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর বড়ো ভাই। রবীন্দ্রনাথের ভগিনী প্রতিভা দেবীর সহিত আশুতোষ চৌধুরী বিবাহ হয়।
প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য প্রমথ চৌধুরী বেশি বিখ্যাত। তার প্রথম প্রবন্ধ জয়দেব প্রকাশিত হয় সাধনা পত্রিকায় ১৮৯৩ সালে। প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল ‘বীরবল’।
প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র বাংলা সাহিত্যে চলতি ভাষারীতি প্রবর্তনে আগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তার প্রবর্তিত গদ্যরীতিতে সবুজপত্র নামে বিখ্যাত সাহিত্যপত্র ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারই নেতৃত্বে বাংলা সাহিত্যে নতুন গদ্যধারা সূচিত হয়।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে ইতালিয় রূপবন্ধের সনেট লিখেছেন। এছাড়াও তিনি বিশ্বভারতী পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
প্রমথ চৌধুরীর রচনাসমগ্র
প্রবন্ধ গ্রন্থ
তেল-নুন-লকড়ী (১৯০৬)
বীরবলের হালখাতা (১৯১৬)
নানাকথা (১৯১৯)
ভাষার কথা
আমাদের শিক্ষা (১৯২০)
রায়তের কথা (১৯১৯)
নানাচর্চা (১৯৩২)
প্রবন্ধ সংগ্রহ (১৯৫২ ১ম খণ্ড ও ১৯৫৩ ২য় খণ্ড)
গল্পগ্রন্থ
চার-ইয়ারী কথা (১৯১৬)
আহুতি (১৯১৯)
নীললোহিত (১৯৪১)
অনুকথা সপ্তক
ঘোষালে ত্রিকথা
কাব্যগ্রন্থ
সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩)
পদচারণ (১৯১৯)
মৃত্যু
প্রমথ চৌধুরী ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ তারিখ ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
ইসলাম, কাজী নজরুল (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। নজরুল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৪ মে ১৮৯৯) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাযারের খাদেম। নজরুলের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যু হলে নজরুল পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য হাজী পালোয়ানের মাযারের সেবক এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। তিনি গ্রামের মকতব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। শৈশবের এ শিক্ষা ও শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে নজরুল অল্পবয়সেই ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠান, যেমন পবিত্র কুরআন পাঠ, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। পরবর্তী জীবনে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে ইসলামি ঐতিহ্যের রূপায়ণে ওই অভিজ্ঞতা সহায়ক হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণমুক্ত কবিতা রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়। নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদন্ডে দন্ডিত করে। নজরুলও আদালতে লিখিত রাজবন্দীর জবানবন্দী দিয়ে এবং প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং এর সমর্থনে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান।
নজরুল তাঁর কবিতায় ব্যতিক্রমী এমন সব বিষয় ও শব্দ ব্যবহার করেন, যা আগে কখনও ব্যবহূত হয়নি। কবিতায় তিনি সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণাকে ধারণ করায় অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তবে মানবসভ্যতার কয়েকটি মৌলিক সমস্যাও ছিল তাঁর কবিতার উপজীব্য।
নজরুল তাঁর সৃষ্টিকর্মে হিন্দু-মুসলিম মিশ্র ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেন। কবিতা ও গানে তিনি এ মিশ্র ঐতিহ্যচেতনাবশত প্রচলিত বাংলা ছন্দোরীতি ছাড়াও অনেক সংস্কৃত ও আরবি ছন্দ ব্যবহার করেন। নজরুলের ইতিহাস-চেতনায় ছিল সমকালীন এবং দূর ও নিকট অতীতের ইতিহাস, সমভাবে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব।
বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারার পরিচর্যা ও পরিপুষ্টি, বাংলা গানকে উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন এবং লোকসঙ্গীতাশ্রয়ী বাংলা গানকে উপমহাদেশের বৃহত্তর মার্গসঙ্গীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্তি নজরুলের মৌলিক সঙ্গীতপ্রতিভার পরিচায়ক। নজরুলসঙ্গীত বাংলা সঙ্গীতের অণুবিশ্ব, তদুপরি উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের বঙ্গীয় সংস্করণ। বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে নজরুল বাংলা গানকে যথার্থ আধুনিক সঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন।
মকতব, মাযার ও মসজিদ-জীবনের পর নজরুল রাঢ় বাংলার (পশ্চিম বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চল) কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করেন। ঐসব লোকনাট্যের দলে বালক নজরুল ছিলেন একাধারে পালাগান রচয়িতা ও অভিনেতা। নজরুলের কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু এ লেটোদল থেকেই। হিন্দু পুরাণের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ও লেটোদল থেকেই শুরু হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল নজরুল লেটো বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেন। এ সময় লেটোদলের জন্য কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি চাষার সঙ, শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের সঙ, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি।
১৯১০ সালে নজরুল পুনরায় ছাত্রজীবনে ফিরে যান। প্রথমে তিনি রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুল এবং পরে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে (পরে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন) ভর্তি হন। শেষোক্ত স্কুলের হেড-মাস্টার ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক; নজরুল তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আর্থিক অনটনের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণির পর নজরুলের ছাত্রজীবনে আবার বিঘ্ন ঘটে। মাথরুন স্কুল ছেড়ে তিনি প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে, পরে এক খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা পদে এবং শেষে আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নেন। এভাবে কিশোর শ্রমিক নজরুল তাঁর বাল্যজীবনেই রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হন।
চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় এবং তাঁর সুবাদেই নজরুল ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এক বছর পর তিনি পুনরায় নিজের গ্রামে ফিরে যান এবং ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল ১৯১৫-১৭ সালে একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে নজরুল সিয়ারসোল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা হলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর নজরুলের সামরিক জীবনের পরিধি। এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির নিকট তিনি ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমভাবে গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন। করাচি সেনানিবাসে বসে রচিত এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ (সওগাত, মে ১৯১৯) নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, জুলাই ১৯১৯) এবং অন্যান্য রচনা: গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা ‘আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য যে, করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা, যেমন: প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। তাছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এমনকি ফারসি কবি হাফিজেরও কিছু গ্রন্থ ছিল। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার শুরু করাচির সেনানিবাসে থাকাবস্থায়ই।
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল দেশে ফিরে কলকাতায় সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি-র অফিসে সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে। শুরুতেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সদ্যোরচিত বাঁধন-হারা উপন্যাস এবং ‘বোধন’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘বাদল প্রাতের শরাব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়া-পারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহরর্ম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দহম্’ প্রভৃতি কবিতা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্যের এ নবীন প্রতিভার প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি পড়ে। কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রের মাধ্যমে নজরুলের ‘খেয়া-পারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতাদুটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বাংলার সারস্বত সমাজে তাঁকে স্বাগত জানান। নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজালুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ সমকালীন মুসলমান সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। অপরদিকে কলকাতার তৎকালীন জমজমাট দুটি সাহিত্যিক আসর ‘গজেনদার আড্ডা’ ও ‘ভারতীয় আড্ডা’য় অতুলপ্রসাদ সেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার সমকালীন শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান। নজরুল ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; তখন থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দু দশক বাংলার দু প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ ছিল।
এ.কে ফজলুল হকের (শেরে-বাংলা) সম্পাদনায় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হলে তার মাধ্যমেই নজরুলের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নজরুলের লেখা ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ প্রবন্ধের জন্য ওই বছরেরই আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত হয় এবং নজরুলের ওপর পুলিশের দৃষ্টি পড়ে। নবযুগ পত্রিকার সাংবাদিকরূপে নজরুল যেমন একদিকে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক জগতের রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থা নিয়ে লিখছিলেন, তেমনি মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে উপস্থিত থেকে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হচ্ছিলেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরোয়া আসর ও অনুষ্ঠানে যোগদান এবং সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তরুণ কবির সংস্কৃতিচর্চাও অগ্রসর হচ্ছিল। নজরুল তখনও নিজে গান লিখে সুর করতে শুরু করেন নি, তবে তাঁর কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে তার স্বরলিপিসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা, যেমন: ‘হয়ত তোমার পাব দেখা’, ‘ওরে এ কোন্ স্নেহ-সুরধুনী’। নজরুলের গান ‘বাজাও প্রভু বাজাও ঘন’ প্রথম প্রকাশিত হয় সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ সালের বৈশাখ সংখ্যায়।
১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাস নজরুলের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ সময়। এ সময় তিনি মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে পরিচিত হন পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে এবং তাঁর সঙ্গেই নজরুল প্রথম কুমিল্লায় বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। এখানে তিনি প্রমীলার সঙ্গে পরিচিত হন এবং এ পরিচয়ের সূত্র ধরেই পরে তাঁরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
কুমিল্লা থেকে নজরুল দৌলতপুর গ্রামে আলী আকবর খানের বাড়িতে গিয়ে কিছুকাল অবস্থান করেন। সেখান থেকে ১৯ জুন পুনরায় কুমিল্লায় ফিরে তিনি ১৭ দিন অবস্থান করেন। তখন অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লা উদ্বেলিত। নজরুল বিভিন্ন শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গাইলেন সদ্যোরচিত ও সুরারোপিত স্বদেশী গান: ‘এ কোনো পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়’, ‘আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে’ প্রভৃতি। এভাবেই কলকাতার সৌখিন গীতিকার ও গায়ক নজরুল কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান এবং পরাধীনতার বিরুদ্ধে জাগরণী গান রচনা ও পরিবেশনার মধ্য দিয়ে স্বদেশী গান রচয়িতা ও রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত হন।
১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে নজরুল আবার কুমিল্লা যান। ২১ নভেম্বর ভারতব্যাপী হরতাল ছিল। নজরুল পুনরায় পথে নামেন এবং অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন: ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ এ সময় তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতে মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলন করছিল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আর মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলনের দর্শনে নজরুল আস্থাশীল ছিলেন না। স্বদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জন আর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদকারী নব্য তুর্কি আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল; তথাপি ভারতের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের জন্যই তিনি ওই দুটি আন্দোলনে যোগদান করেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পর নজরুলের দুটি ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘ভাঙার গান’ সঙ্গীত। এ দুটি রচনা বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল; ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুল বিপুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯২১ সালের শেষদিকে নজরুল আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’ রচনা করেন, যার মাধ্যমে তাঁর সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনা এবং ভারতীয় মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল তাঁর রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্ব দ্বারা, কারণ তিনি সামন্ততান্ত্রিক খিলাফত বা তুরস্কের সুলতানকে উচ্ছেদ করে তুরস্ককে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। তুরস্কের সমাজজীবন থেকে মোস্তফা কামাল যে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করেছিলেন, তা নজরুলকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, তুরস্কে যা সম্ভবপর, ভারত ও বাংলায় তা সম্ভবপর নয় কেন? বস্ত্তত, গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও আচারসর্বস্বতা থেকে দেশবাসী, বিশেষত স্বধর্মীদের মুক্তির জন্য নজরুল আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। নজরুলের লাঙল ও গণবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত’ এবং ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে রক্তপতাকার গান এর প্রমাণ।
১৯২২ সালে নজরুলের যেসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় সেসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গল্প-সংকলন ব্যথার দান, কবিতা-সংকলন অগ্নি-বীণা ও প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী। বাংলা কবিতার পালাবদলকারী কাব্য অগ্নি-বীণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং পরপর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়; কারণ এ কাব্যে নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে সাড়া জাগানো এবং বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কবিতা সংকলিত হয়েছিল।
১৯২২ সালে নজরুলের অপর বিপ্লবী উদ্যম হলো ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশ (১২ আগস্ট)। পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। বিশের দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর সশস্ত্র বিপ্লববাদের পুনরাবির্ভাবে ধূমকেতু পত্রিকার তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। এক অর্থে এ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপত্র। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। অাঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এ দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ রবীন্দ্রনাথের এ আশীর্বাণী শীর্ষে ধারণ করে। ধূমকেতুর ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হলে ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয়। নজরুলের প্রবন্ধগ্রন্থ যুগবাণী বাজেয়াপ্ত হয় ২৩ নভেম্বর ১৯২২। একই দিনে নজরুলকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয়। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে যে জবানবন্দী প্রদান করেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তা ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে সাহিত্য-মর্যাদা পেয়ে আসছে। ১৬ জানুয়ারি বিচারের রায়ে নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন।
নজরুল যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য তাঁকে উৎসর্গ করেন (২২ জানুয়ারি ১৯২৩)। এ ঘটনায় উল্লসিত নজরুল জেলখানায় বসে তাঁর অনুপম কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ রচনা করেন। সমকালীন অনেক রবীন্দ্রভক্ত ও অনুরাগী কবি-সাহিত্যিক বিষয়টি ভালো চোখে দেখেন নি। এ ব্যাপারে কেউ কেউ অভিযোগ করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের নজরুল-কাব্যপাঠের পরামর্শ দেন এবং বলেন, ‘...যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।’
১৯২৩ সালের ১৪ এপ্রিল নজরুলকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। রাজবন্দিদের প্রতি ইংরেজ জেল-সুপারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে ওই দিন থেকেই তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানিয়ে নজরুলকে টেলিগ্রাম করেন: ‘Give up hunger strike, our literature claims you.’ অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষের বিরূপ মনোভাবের কারণে নজরুল টেলিগ্রামটি পান নি। এদিকে জনমতের চাপে ১৯২৩ সালের ২২ মে জেল-পরিদর্শক ড. আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী হুগলি জেল পরিদর্শন করেন এবং তাঁর আশ্বাস ও অনুরোধে ওই দিনই নজরুল চল্লিশ দিনের অনশন ভঙ্গ করেন। নজরুলকে ১৯২৩ সালের ১৮ জুন বহরমপুর জেলে স্থানান্তর করা হয় এবং এক বছর তিন সপ্তাহ কারাবাসের পর ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। হুগলি জেলে বসে নজরুল রচনা করেন ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল’, আর বহরমপুর জেলে ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেল্ছে জুয়া’ এ বিখ্যাত গান দুটি।
নজরুলের প্রেম ও প্রকৃতির কবিতার প্রথম সংকলন দোলন-চাঁপা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালের অক্টোবরে। এতে সংকলিত দীর্ঘ কবিতা ‘পূজারিণী’-তে নজরুলের রোমান্টিক প্রেম-চেতনার বহুমাত্রিক স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে।
১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রমীলা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। তাঁর মা গিরিবালা দেবী ছাড়া পরিবারের অন্যরা এ বিবাহ সমর্থন করেননি। নজরুলও আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। হুগলির মহীয়সী মহিলা মিসেস মাসুমা রহমান বিবাহপর্বে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। নজরুল হুগলিতে সংসার পাতেন।
১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নজরুলের গান ও কবিতা সংকলন বিষের বাঁশী এবং একই মাসে ভাঙ্গার গান প্রকাশিত হয়। দুটি গ্রন্থই ওই বছর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।
১৯২৫ সালে নজরুলের গানের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় হিজ মাস্টার্স ভয়েস (এইচ.এম.ভি) কোম্পানি থেকে, যদিও ১৯২৮ সালের আগে নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট হন নি। শিল্পী হরেন্দ্রনাথ দত্তের কণ্ঠে ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেল্ছে জুয়া’ ও ‘যাক পুড়ে যাক বিধির বিধান সত্য হোক’ গান দুটি রেকর্ড করা হয়।
নজরুল এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং স্বরচিত স্বদেশী গান পরিবেশন করে পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি তাঁর একটি জনপ্রিয় স্বদেশী গান ‘ঘোর্ রে ঘোর্ রে আমার সাধের চর্কা ঘোর’ ১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে পরিবেশন করেন। ১৯২৫ সালের শেষ দিকে নজরুল প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি কুমিল্লা, মেদিনীপুর, হুগলি, ফরিদপুর, বাঁকুড়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন। নজরুল এ সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্য হওয়া ছাড়াও শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের জন্য ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল’ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। রাজনীতিক নজরুলের একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল সাপ্তাহিক লাঙ্গল পত্রিকা প্রকাশ (১৬ ডিসেম্বর ১৯২৫)। তিনি এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এর প্রথম সংখ্যাতেই নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতাসমষ্টি মুদ্রিত হয়। লাঙ্গল ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম শ্রেণিসচেতন সাপ্তাহিক পত্রিকা। এতে প্রকাশিত ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলে’র ম্যানিফেস্টোতে প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়। এ সময় নজরুল পেশাজীবী শ্রমিক-কৃষক সংগঠনের উপযোগী সাম্যবাদী ও সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন।
১৯২৬ সালে নজরুল কৃষ্ণনগরে বসবাস শুরু করেন এবং বাংলা গানে এক নতুন ধারার সংযোজন করেন। তিনি স্বদেশী গানকে স্বাধীনতা ও দেশাত্মবোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বহারা শ্রেণির গণসঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন। স্মরণীয় যে, ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে নজরুল কলকাতার প্রথম বামপন্থী সাপ্তাহিক গণবাণীর (১৯২৭ সালের ১২ আগস্ট থেকে গণবাণী ও লাঙ্গল একীভূত হয়) জন্য রচনা করেন ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ ও ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে ‘জাগো অনশন বন্দী’, ‘রক্তপতাকার গান’ ইত্যাদি। ১৯২৫ সালে নজরুলের প্রকাশনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: গল্প-সংকলন রিক্তের বেদন, কবিতা ও গানের সংকলন চিত্তনামা, ছায়ানট, সাম্যবাদী ও পূবের হাওয়া। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের অগ্রদূত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অকাল মৃত্যুতে (১৬ জুন ১৯২৫) শোকাহত নজরুল কর্তৃক রচিত গান ও কবিতা নিয়ে চিত্তনামা গ্রন্থটি সংকলিত হয়।
১৯২৬ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চ পরিষদের সদস্যপদের জন্য পূর্ববঙ্গ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নজরুলের রাজনৈতিক জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ উপলক্ষে তিনি পূর্ববাংলায়, বিশেষত ঢাকা বিভাগে ব্যাপকভাবে সফর করেন। স্কুলজীবনে ত্রিশাল-দরিরামপুরে থাকাকালে এ অঞ্চল সম্পর্কে তাঁর যে অভিজ্ঞতার সূত্রপাত হয়, রাজনৈতিক ও বৈবাহিক কারণে তা আরও গভীর হয়।
নজরুল ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা। গণসঙ্গীত ও গজলে যৌবনের দুটি বিশিষ্ট দিক সংগ্রাম ও প্রেমের পরিচর্যাই ছিল মুখ্য। নজরুল গজল আঙ্গিক সংযোজনের মাধ্যমে বাংলা গানের প্রচলিত ধারায় বৈচিত্র্য আনয়ন করেন। তাঁর অধিকাংশ গজলের বাণীই উৎকৃষ্ট কবিতা এবং তার সুর রাগভিত্তিক। আঙ্গিকের দিক থেকে সেগুলি উর্দু গজলের মতো তালযুক্ত ও তালছাড়া গীত। নজরুলের বাংলা গজল গানের জনপ্রিয়তা সমকালীন বাংলা গানের ইতিহাসে ছিল তুলনাহীন। ১৯২৬-২৭ সালে কৃষ্ণনগর জীবনে নজরুল উভয় ধারায় বহুসংখ্যক গান রচনা করেন। ওই সময়ে তিনি নিজের গানের স্বরলিপি প্রকাশ করতে থাকেন। এসব গান থেকে স্পষ্ট হয় যে, নজরুলের সৃজনশীল মৌলিক সঙ্গীত প্রতিভার প্রথম স্ফুরণ ঘটে ১৯২৬-২৭ সালে কৃষ্ণনগরে। অথচ নজরুলের কৃষ্ণনগর জীবন ছিল অভাব-অনটন, রোগ-শোক ও দুঃখ-দারিদ্র্যক্লিষ্ট। তখনও পর্যন্ত নজরুল কোনো প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন নি, তবে দিলীপকুমার রায় ও সাহানা দেবীর মতো বড় মাপের শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ নজরুলের গানকে বিভিন্ন আসরে ও অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে জনপ্রিয় করে তোলেন।
১৯২৭ সালে একদিকে সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি-তে রক্ষণশীল হিন্দু বিশেষত ব্রাহ্মণসমাজের একটি অংশ থেকে, অপরদিকে মৌলবাদী মুসলমান সমাজের ইসলাম দর্শন, মোসলেম দর্পণ প্রভৃতি পত্রিকায় নজরুল-সাহিত্যের বিরূপ সমালোচনার ঝড় ওঠে। শনিবারের চিঠি-তে নজরুলের বিভিন্ন রচনার প্যারডি প্রকাশিত হতে থাকে। তবে নজরুলের সমর্থনে কল্লোল, কালিকলম প্রভৃতি প্রগতিশীল পত্রিকা এগিয়ে আসে। ১৯২৭ সালে নজরুলের কবিতা ও গানের সংকলন ফণি-মনসা এবং পত্রোপন্যাস বাঁধন হারা প্রকাশিত হয়।
১৯২৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা মুসলিম সাহিত্য সমাজ-এর প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমাজ-এর দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য পুনরায় ঢাকা আসেন। সেবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, ছাত্র বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত এবং গণিতের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচিত হন। একই বছর জুন মাসে পুনরায় ঢাকা এলে সঙ্গীত চর্চাকেন্দ্রের রানু সোম (প্রতিভা বসু) ও উমা মৈত্রের (লোটন) সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা হয়। অর্থাৎ এ সময় পরপর তিনবার ঢাকায় এসে নজরুল ঢাকার প্রগতিশীল অধ্যাপক, ছাত্র ও শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ওদিকে ১৯২৮ সালে কলকাতায় মওলানা মৈাহাজ্ঞঞ্ছদ আকরমখাঁ-র মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় নজরুল-বিরোধিতা শুরু হয়, কিন্তু মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সওগাত পত্রিকা বলিষ্ঠভাবে নজরুলকে সমর্থন করে। নজরুল সওগাতে যোগদান করে একটি রম্য বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সওগাতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আবুল কালাম শামসুদ্দীন নজরুলকে যুগপ্রবর্তক কবি ও বাংলার জাতীয় কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
নজরুল ১৯২৮ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে, ১৯২৯ সালে বেতার ও মঞ্চের সঙ্গে এবং ১৯৩৪ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত তিনি এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে সঙ্গীত-রচয়িতা ও প্রশিক্ষকরূপে যুক্ত ছিলেন। এইচ.এম.ভি-তে নজরুলের প্রশিক্ষণে প্রথম রেকর্ডকৃত তাঁর দুটি গান ‘ভুলি কেমনে’ ও ‘এত জল ও কাজল চোখে’ গেয়েছিলেন আঙ্গুরবালা। নজরুলের নিজের প্রথম রেকর্ড ছিল স্বরচিত ‘নারী’ কবিতার আবৃত্তি। নজরুল কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম অনুষ্ঠান প্রচার করেন ১৯২৯ সালের ১২ নভেম্বর সান্ধ্য অধিবেশনে। ১৯২৯ সালে মনোমোহন থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের রক্তকমল নাটকের জন্য নজরুল গান রচনা ও সুর সংযোজনা করেন। শচীন্দ্রনাথ ওই নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। ১৯৩০ সালে মঞ্চস্থ মন্মথ রায়ের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী নাটক কারাগার-এ নজরুলের আটটি গান ছিল, নাটকটি একটানা ১৮ রজনী মঞ্চস্থ হওয়ার পর সরকার নিষিদ্ধ করে।
১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালিদের পক্ষ থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, অভিনন্দন-পত্র পাঠ করেন ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলি, শুভেচ্ছা ভাষণ দেন বিশিষ্ট রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু (নেতাজী) এবং রায়বাহাদুর জলধর সেন। কবিকে সোনার দোয়াত-কলম উপহার দেওয়া হয়। এ সংবর্ধনা সভায় প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে।’ সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে! আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।’
১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুল চট্টগ্রাম সফরে আসেন এবং হবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন্নাহার ভাইবোনের আতিথ্য গ্রহণ করেন; বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহমদের জন্মস্থান সনদ্বীপও ভ্রমণ করেন। ১৯২৮-২৯ সালে নজরুলের প্রকাশিত কবিতা ও গানের সংকলনের মধ্যে ছিল: সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৮), সঞ্চিতা (১৯২৮); বুলবুল (১৯২৮), জিঞ্জীর (১৯২৮) ও চক্রবাক (১৯২৯)। ১৯২৯ সালে কবির তৃতীয় পুত্র কাজী সব্যসাচীর জন্ম হয়, আর মে মাসে চার বছরের প্রিয়পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যায়। কবি এতে প্রচন্ড আঘাত পান। অনেকে বলেন এ মৃত্যু কবির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি ক্রমশ অন্তর্মুখী হয়ে ওঠেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। বুলবুলের রোগশয্যায় বসে নজরুল হাফিজের রুবাইয়াৎ অনুবাদ করছিলেন, যা পরে রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল নজরুলের রাজনৈতিক উপন্যাস মৃত্যুক্ষুধা, গানের সংকলন নজরুল-গীতিকা, নাটিকা ঝিলিমিলি এবং কবিতা ও গানের সংকলন প্রলয়-শিখা ও চন্দ্রবিন্দু। শেষোক্ত গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত এবং প্রলয়-শিখা-র জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত আদালতের রায়ে নজরুলের ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ হয়, নজরুল হাইকোর্টে আপিল ও জামিন লাভ করেন। ইতোমধ্যে গান্ধী-আরউইন চুক্তির ফলে হাইকোর্ট কর্তৃক নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা খারিজের আদেশ দেওয়া হয়, ফলে নজরুলকে দ্বিতীয়বার কারাবাস করতে হয় নি।
১৯৩১ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত নজরুল দার্জিলিং সফর করেন। রবীন্দ্রনাথও তখন দার্জিলিং-এ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়। এ বছর প্রকাশিত হয় নজরুলের উপন্যাস কুহেলিকা, গল্প-সংকলন শিউলিমালা, গানের স্বরলিপি নজরুল-স্বরলিপি এবং গীতিনাট্য আলেয়া। নজরুলের এ নাটকটি কলকাতার নাট্যনিকেতনে (৩ পৌষ ১৩৩৮) প্রথম মঞ্চস্থ হয়। এতে গানের সংখ্যা ছিল ২৮টি। ওই বছর নজরুল আরও যেসব নাটকের জন্য গান রচনা ও সুরারোপ করেন সেসবের মধ্যে ছিল যতীন্দ্রমোহন সিংহের ধ্রুবতারা উপন্যাসের নাট্যরূপের চারটি গান (কেবল সুর সংযোজন), মন্মথ রায়ের সাবিত্রী নাটকের ১৩টি গান (রচনা ও সুরারোপ)। ১৯৩২ সালে কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত মন্মথ রায়ের মহুয়া নাটকের গানগুলির রচয়িতাও ছিলেন নজরুল।
১৯৩২ সালের নভেম্বর মাসে নজরুল সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় মুসলমান তরুণ সম্মেলনে এবং ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনের সভাপতি কবি কায়কোবাদ নজরুলকে মাল্যভূষিত করেন। ১৯৩২ সালে নজরুলের প্রকাশনার মধ্যে সবগুলিই ছিল গীতিসংকলন, যেমন: সুর-সাকী, জুলফিকার ও বন-গীতি।
১৯৩২-৩৩ সাল এক বছর নজরুল এইচ.এম.ভি ছেড়ে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ কোম্পানির রেকর্ড করা প্রথম দুটি নজরুলসঙ্গীত ছিল ধীরেন দাসের গাওয়া ‘জয় বাণী বিদ্যাদায়িনী’ ও ‘লক্ষ্মী মা তুই’। ১৯৩৩ সালে নজরুল এক্সক্লুসিভ কম্পোজাররূপে এইচ.এম.ভি-তে পুনরায় যোগদান করেন। এ সময় তাঁর অনেক গান রেকর্ড হয়। ১৯৩৩ সালে নজরুল তিনটি মূল্যবান অনুবাদ-কর্ম সমাপ্ত করেন: রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম এবং কাব্য আমপারা।
রেকর্ড, বেতার ও মঞ্চের পর নজরুল ১৯৩৪ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি প্রথমে যে ছায়াছবির জন্য কাজ করেন সেটি ছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের কাহিনী ভক্ত ধ্রুব (১৯৩৪)। এ ছায়াছবির পরিচালনা, সঙ্গীত রচনা, সুর সংযোজনা ও পরিচালনা এবং নারদের ভূমিকায় অভিনয় ও নারদের চারটি গানের প্লেব্যাক নজরুল নিজেই করেন। ছবির আঠারোটি গানের মধ্যে সতেরোটির রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন নজরুল। এ ছাড়া তিনি আর যেসব চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সেগুলি হলো: পাতালপুরী (১৯৩৫), গ্রহের ফের (১৯৩৭), বিদ্যাপতি (বাংলা ও হিন্দি ১৯৩৮), গোরা (১৯৩৮), নন্দিনী (১৯৪৫) এবং অভিনয় নয় (১৯৪৫)। বিভিন্ন ছায়াছবিতে ১৯৪৫ সালের মধ্যে ব্যবহূত নজরুলসঙ্গীতের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। চলচ্চিত্রের মতো মঞ্চনাটকের সঙ্গেও নজরুল ত্রিশের দশকে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯২৯ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে নিজের রচিত দুটি নাটক আলেয়া ও মধুমালা সহ প্রায় ২০টি মঞ্চ নাটকের সঙ্গে নজরুল যুক্ত ছিলেন এবং সেসবে প্রায় ১৮২টি নজরুলসঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এরূপ কয়েকটি নাটক হলো: রক্তকমল, মহুয়া, জাহাঙ্গীর, কারাগার, সাবিত্রী, আলেয়া, সর্বহারা, সতী, সিরাজদ্দৌলা, দেবীদুর্গা, মধুমালা, অন্নপূর্ণা, নন্দিনী, হরপার্বতী, অর্জুনবিজয়, ব্ল্যাক আউট ইত্যাদি। ১৯৩৪ সালে নজরুল-প্রকাশনার সবই ছিল সঙ্গীত-বিষয়ক, যেমন: গীতি-শতদল ও গানের মালা গীতিসংকলন এবং সুরলিপি ও সুরমুকুর স্বরলিপি সংগ্রহ।
১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে নজরুল কলকাতা বেতারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে অনেক মূল্যবান সঙ্গীতানুষ্ঠান প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘হারামণি’, ‘মেল-মিলন’ ও ‘নবরাগমালিকা’। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে নজরুল বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর সহযোগিতায় কলকাতা বেতার থেকে অনেক রাগভিত্তিক ব্যতিক্রমধর্মী সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশন করেন, যা ছিল নজরুলের সঙ্গীতজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৩৯ সালে নজরুল বেতারের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত থাকলেও এইচ.এম.ভি, মেগাফোন, টুইন ছাড়াও কলম্বিয়া, হিন্দুস্থান, সেনোলা, পাইওনিয়ার, ভিয়েলোফোন প্রভৃতি থেকেও নজরুলসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালের মধ্যে নজরুলের এইচ.এম.ভি থেকে ৫৬৭টি, টুইন থেকে ২৮০টি, মেগাফোন থেকে ৯১টি, কলম্বিয়া থেকে ৪৪টি, হিন্দুস্থান থেকে ১৫টি, সেনোলা থেকে ১৩টি, পাইওনিয়ার থেকে ২টি, ভিয়েলোফোন থেকে ২টি এবং রিগ্যান থেকে ১টি মিলে প্রায় সহস্রাধিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। সব মিলে নজরুলের গানের সংখ্যা দ্বিসহস্রাধিক।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮) রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করেন ‘রবিহারা’ ও ‘সালাম অস্তরবি’ কবিতা এবং ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ শোকসঙ্গীত। ‘রবিহারা’ কবিত্র্রা নজরুল স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেন কলকাতা বেতারে, গ্রামোফোন রেকর্ডে। ‘ঘুমাইতে দাও’ গানটিও কয়েকজন শিল্পীকে নিয়ে স্বকণ্ঠে গেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যেই নজরুল নিজেও অসুস্থ এবং ক্রমশ নির্বাক ও সম্বিতহারা হয়ে যান। দেশে ও বিদেশে কবির চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় বটে, কিন্তু কোনো সুফল পাওয়া যায় নি। ১৯৪২ সালের জুলাই থেকে ১৯৭৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪টি বছর কবির এ অসহনীয় নির্বাক জীবনকাল অতিবাহিত হয়।
ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ (১২ ভাদ্র ১৩৮৩) ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
গীতাঞ্জলি হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ। এই বইয়ে মোট ১৫৭টি গীতিকবিতা সংকলিত হয়েছে। কবিতাগুলি ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন ভক্তিমূলক রচনা। এর বেশিরভাগ কবিতাতেই রবীন্দ্রনাথ নিজে সুরারোপ করেছিলেন। ১৯০৮-০৯ সালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই কবিতাগুলি প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯১০ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
বাল্মীকি-প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি গীতিনাট্য। ১৮৮১ সালে প্রকাশিত এই নাটকটি রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম নাট্যসাহিত্য। ১৮৮১ সালেই প্রথম মঞ্চায়িত হয় এই নাটক। বাল্মীকি-প্রতিভা –র আখ্যানবস্তু কৃত্তিবাসি রামায়ণ থেকে গৃহীত। নাটকের আঙ্গিকে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুর নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছে। এই নাটকের হাত ধরেই বাংলায় গীতিনাট্য ঐতিহ্যের সূচনা হয়। বাল্মীকি-প্রতিভা রচনার অব্যবহিত পরে এর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ কালমৃগয়া নামক আর একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন।
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ব্রজবুলি ভাষায় রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ কৈশোর ও প্রথম যৌবনে "ভানুসিংহ" ছদ্মনামে বৈষ্ণব কবিদের অনুকরণে কিছু পদ রচনা করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলিই ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন সময়ে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাগুলি রচনার ইতিহাস পরবর্তীকালে জীবনস্মৃতি গ্রন্থের ভানুসিংহের কবিতা অধ্যায় বিবৃত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
চোখের বালি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি সামাজিক উপন্যাস। ১৯০১-০২ সালে নবপর্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯০৩ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের বিষয় "সমাজ ও যুগযুগান্তরাগত সংস্কারের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ"। আখ্যানভাগ সংসারের সর্বময় কর্ত্রী মা, এক অনভিজ্ঞা বালিকাবধূ, এক বাল্যবিধবা ও তার প্রতি আকৃষ্ট দুই পুরুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।
উদ্ধৃতিসমূহঃ
❁আশা করিবার অধিকারই মানুষের শক্তিকে প্রবল করিয়া তোলে।
❁ মানবের মধ্যে দেবতার প্রকাশ, সংসারের মধ্যে দেবতার প্ৰতিষ্ঠা, আমাদের প্রতি মুহূর্তের সুখ-দুঃখের মধ্যে দেবতার সঞ্চার, ইহাই নব হিন্দুধর্মের মর্মকথা হইয়া উঠল।
❁ যাহার হৃদয়ে যত সৌন্দর্য বিরাজ করিতেছে সে তত সৌন্দর্য উপভোগ করিতে পারে। সৌন্দর্যের সহিত তাহার নিজের ঐক্য যতই সে বুঝিতে পারে ততই সে আনন্দ লাভ করে। আমি যে এত ফুল ভালোবাসি তাহার কারণ আর কিছু নয়, ফুলের সহিত আমার হৃদয়ের গূঢ় একটি ঐক্য আছে - আমার মনে হয় ও একই কথা, যে সৌন্দর্য ফুল হইয়া ফুটিয়াছে, সেই সৌন্দর্যই অবস্থাভেদে আমার হৃদয় হইয়া বিকশিত হইয়াছে।
❁ বহুবিধ বিষয় পাঠনার ব্যবস্থা করিলেই যে শিক্ষায় লাভের অংক অগ্রসর হয় তাহা নহে, মানুষ যে বাড়ে সে'ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন'। যেখানে নিভৃতে তপস্যা হয় সেখানেই আমরা শিখতে পারি। যেখানে গোপনে ত্যাগ, যেখানে একান্তে সাধনা, সেখানেই আমরা শক্তিলাভ করি। যেখানে সম্পূর্ণভাবে দান সেখানেই সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ সম্ভবপর। যেখানে অধ্যাপকগন জ্ঞানের চর্চায় স্বয়ং প্রবৃত্ত সেখানেই ছাত্রগণ বিদ্যাকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পায়। বাহিরে বিশ্বপ্রকৃতির আবির্ভাব যেখানে বাধাহীন অন্তরে সেখানেই মন সম্পূর্ন বিকশিত। ব্রহ্মচর্জের সাধনায় চরিত্র যেখানে সুস্থ এবং আত্মবশ, ধর্মশিক্ষা সেখানেই সরল ও স্বাভাবিক।
❁ চোখে দেখিস, প্রাণে কানা হিয়ার মাঝে দেখ না ধরে ভুবনখানা।
❁বিশ্বকে আমরা জানি, তার কারণ বিশ্বে সত্যের আবির্ভাব। বিশ্বে আমাদের তৃপ্তি, তার কারণ বিশ্ব আনন্দের প্রকাশ।
❁বল, বুদ্ধি ও ঐশ্বর্য মনুষ্যত্বের একটা অঙ্গ হইতে পারে, কিন্তু শান্তি, সামঞ্জস্য এবং মঙ্গলও কি তদপেক্ষা উচ্চতর অঙ্গ নহে।
❁বই পড়াটা যে শিক্ষার একটা সুবিধাজনক সহায়মাত্র তাহা আর আমাদের মনে হয় না, আমরা বই পড়াটাকে শিক্ষার একমাত্র উপায় বলিয়া ঠিক করিয়া বসিয়া আছি। মনের জীবন মননক্রিয়া এবং সেই জীবনেই মনুষ্যত্ব।
❁আনন্দ যে রূপ ধরেছে এই তো হল রস।
❁শিখিবার কালে, বাড়িয়া উঠিবার সময়ে প্রকৃতির সহায়তা নিতান্তই চাই।
❁ বইয়ের ভিতর দিয়া জানাইকে আমরা পান্ডিত্য বলিয়া গর্ব করি। জগৎকে আমরা মন দিয়ে ছুঁই না, বই দিয়ে ছুঁই।
❁আমাদের স্কুল-কলেজেও তপস্যা আছে, কিন্তু সে মনের তপস্যা, তপস্যা, বোধের তপস্যা নয়। .... বোধের তপস্যার বাধা হচ্ছে রিপুর বাধা। প্রবৃত্তি অসংগত হয়ে উঠলে চিত্তের সাম্য থাকে না, সুতরাং বোধ বিকৃত হয়ে যায়। কামনার জিনিসকে আমরা শ্রেয় দেখি, সে জিনিসটা সত্যই শ্রেয় বলে নয়, আমাদের কামনা আছে বলেই। লোভের জিনিসকে আমরা বড়ো দেখি, সে জিনিস সত্যই বড়ো বলে নয়, আমাদের লোভ আছে বলেই।
❁আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়, যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।
ঝরাপালক
বনফুল
পূরবী
শ্যামলী
রূপসী বাংলার, তিমির হননের ও ধূসরতার কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো - ঝরাপালক (১৯২৭, এটি কবির ১ম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ) , ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১) ।
তাঁর ১ম উপন্যাস - মাল্যবান (১৯৭৩)। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস - সুতীর্থ, কল্যাণী, কারুবাসনা।
জীবনানন্দ দাশ রচিত প্রবন্ধ: কবিতার কথা।
তাঁর একটি আলোচিত কবিতা হলো - অদ্ভুত আঁধার এক।
জন্ম : ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯, বরিশালে (আদি নিবাস বিক্রমপুরের গাওপাড়া গ্রামে)
মৃত্যু: ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর, ট্রাম দুর্ঘটনায় ।
পিতা-মাতা: তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশ একজন কবি। তার পিতা ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য:-
==> মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি।
==> জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়।
==> ১৯৫৫ সালে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
ঝরাপালক
বনফুল
পূরবী
শ্যামলী
মহাপৃথিবী
উত্তর ফাল্গুনী
ঝরাপালক
বনলতা সেন
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) কথাসাহিত্যিক। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টম্বর পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম। তাঁর পৈতৃক নিবাস ওই জেলারই ব্যারাকপুর গ্রামে। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত; পান্ডিত্য ও কথকতার জন্য তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন।
স্বগ্রামের পাঠশালায় বিভূতিভূষণের পড়াশোনা শুরু হয়। তিনি বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এন্ট্রান্স (১৯১৪) ও আইএ (১৯১৬) উভয় পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বিএ (১৯১৮) পরীক্ষায়ও তিনি ডিসটিংকশনসহ পাস করেন। পরে এমএ ও আইন বিষয়ে ভর্তি হয়েও পাঠ অসমাপ্ত রেখে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি হুগলির একটি মাইনর স্কুলে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। কিছুদিন তিনি ‘গোরক্ষিণী সভা’র ভ্রাম্যমাণ প্রচারক হিসেবে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। পরে তিনি খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে সেক্রেটারি ও গৃহশিক্ষক এবং তাঁর এস্টেটের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজার হন। পরে ধর্মতলাস্থ খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর তিনি গোপালনগর স্কুলে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
১৩২৮ বঙ্গাব্দের (১৯২১) মাঘ প্রবাসীতে প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়। ভাগলপুরে চাকরি করার সময় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পথের পাঁচালী রচনা শুরু করেন এবং শেষ করেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে।
তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো:-
অপরাজিত (১৯৩১),
মেঘমল্লার (১৯৩১),
মৌরীফুল (১৯৩২),
যাত্রাবদল (১৯৩৪),
চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭),
কিন্নরদল (১৯৩৮),
আরণ্যক (১৯৩৯),
আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০),
মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০),
স্মৃতির রেখা (১৯৪১),
দেবযান (১৯৪৪),
হীরামানিক জ্বলে (১৯৪৬),
উৎকর্ণ (১৯৪৬),
হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮),
ইছামতী (১৯৫০),
অশনি সংকেত (১৯৫৯) ইত্যাদি।
পথের পাঁচালী বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ রচনা। প্রথম রচিত এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। অপরাজিত পথের পাঁচালীরই পরবর্তী অংশ। উভয়গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীকে চলচ্চিত্রে রূপদানের মাধ্যমে তাঁর পরিচালক জীবন শুরু করেন এবং এর জন্য তিনি দেশিবিদেশী বহু পুরস্কার লাভ করেন। তিনি অপরাজিত এবং অশনি সংকেত উপন্যাস দুটি অবলম্বনেও অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। পথের পাঁচালী উপন্যাসটি ভারতীয় বিভিন্ন ভাষাসহ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীর রচনায় পল্লীর জীবন ও নিসর্গ রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের চালচিত্র ও মানবজীবনের অন্তর্লীন সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনায় প্রকৃতি কেবল প্রকৃতিরূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব রসমূর্তি ধারণ করেছে। মানুষ যে প্রকৃতিরই সন্তান এ সত্য তাঁর বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে স্বস্বভাবে তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীনবচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বিভূতিভূষণ সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। তিনি চিত্রলেখা (১৯৩০) নামে একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া হেমন্তকুমার গুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি দীপক (১৯৩২) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র-পুরস্কার’ (১৯৫১) লাভ করেন। ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর ব্যারাকপুরের ঘাটশিলায় তাঁর মৃত্যু হয়।
বুদ্ধদেব বসু বিংশ শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে আধুনিক কবিতার যারা পথিকৃৎ তিনি তাদের একজন। তিনি বাংলা সাহিত্য সমালোচনার দিকপাল ও কবিতা পত্রিকার প্রকাশ ও সম্পাদনার জন্য তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত।
বাংলা সাহিত্য রচনাসম্ভার সংখ্যার বিচারে স্বল্প হলেও বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নাম আবু ইসহাক । বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মৌলভী মোহাম্মদ এবাদুল্লা ও আতহারুন্নিসা দম্পত্তির ছয় সন্তানের মধ্যে আবু ইসহাক ছিলেন পঞ্চম । ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের খণ্ডচিত্র যেমন স্থান পেয়েছে তার লেখনিতে তেমনি বাংলার স্বাধীনতা পরবর্তী চিত্রও তুলে ধরেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে । আবু ইসহাক বাংলা ভাষার নতুন ধরনের অভিধান প্রণেতা হিসেবেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ।
বাংলা সাহিত্য রচনাসম্ভার সংখ্যার বিচারে স্বল্প হলেও বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নাম আবু ইসহাক ।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মৌলভী মোহাম্মদ এবাদুল্লা ও আতহারুন্নিসা দম্পত্তির ছয় সন্তানের মধ্যে আবু ইসহাক ছিলেন পঞ্চম ।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের খণ্ডচিত্র যেমন স্থান পেয়েছে তার লেখনিতে তেমনি বাংলার স্বাধীনতা পরবর্তী চিত্রও তুলে ধরেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে ।
আবু ইসহাক বাংলা ভাষার নতুন ধরনের অভিধান প্রণেতা হিসেবেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ।
সাহিত্যিক আবু ইসহাক জন্মগ্রহণ করেন – ১ নভেম্বর, ১৯২৬ সালে, শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার শিরঙ্গল গ্রামে ।
বিশিষ্ট এই সাহিত্যিকের শিক্ষা জীবন – নড়িয়া ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে এসএসসি, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ হতে ১৯৪৪ সালে এইচএসসি এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৬০ সালে স্নাতক ।
স্বামী পরিত্যক্তা জয়গুনের দু-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, গ্রাম ছেড়ে নগরজীবন গ্রহণ, আবার গ্রামেই ফিরে আসলে সমাজপতিদের ধর্বান্ধতা ও প্রতিহিংসা প্রভৃতি যে উপন্যাসের বিষয়বস্তু – আবু ইসহাকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের ।
’সূর্য-দীঘল বাড়ী’ বিখ্যাত এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় – ধারাবাহিকভাবে (১৯৫০-৫১) পর্যন্ত মাসিক নওবাহার পত্রিকায় (গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে) ।
আবু ইসহাক ‘সূর্য- দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের তুলে ধরেছেন – বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশ ভাগ ।
আবু ইসহাকের প্রথম প্রকাশিত রচনার নাম – ১৯৪০ সালে নবযুগ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অভিশাপ’ গল্পটি ।
’সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপদান করেন – শেখ নিয়ামত আলী ও মসীহউদ্দিন শাকের (১৯৭৯) সালে ।
পদ্মার বুকে জেগে ওঠা নতুন চরের দখল নিয়ে দুই গোষ্ঠীর সংঘাত, খুন, হিংসা বিদ্বেষ, স্বার্থপর মানুষের সম্পদের লোভ প্রভৃতি যে উপন্যাসের আলোচ্য বিষয় – আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসের ।
’পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় – প্রথমে বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘মুখর মাটি’ নামে (১৯৮৬) সালে । এই উপন্যাসে প্রধান প্রধান চরিত্রের মধ্যে রয়েছে – জরিনা, রূপজাল, ফজল, এরফান মাতবর, জঙ্গুরুল্লা প্রভৃতি ।
লেখক যখন পুলিশ ছিলেন তখন বেশ কিছু জাল নোটের মামলা তদন্ত করেছিলেন সেই আলোকে রচনা করেছিলেন – ‘জাল’ উপন্যাস ।
আবু ইসহাকের উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় – আনন্দ পত্র পত্রিকায় (১৯৮৮ সালে) । ”লাঠির জোরে মাটি, লাঠালাঠি কাটাকাটি, আদালতে হাঁটাহাঁটি, এই না হলে চরের মাটি, হয় কবে খাঁটি”- উক্তিটি যে উপন্যাসের – আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসের ।
আবু ইসহাকের গল্প গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে – হারেম (১৯৬২) ও মহাপতঙ্গ (১৯৬৩) । নিজের জীবনের স্মৃতি তুলে ধরেছেন তাঁর নকশাধর্মী রচনা – ‘স্মৃতিবিচিত্র’ নামক স্মৃতিকথায় ।
’জয়ধ্বনি’ আবু ইসহাকের যে শ্রেণির রচনা – একমাত্র নাটক (ধানশালিকের দেশ পত্রিকায় ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়) ।
’একটি ময়নার আত্মকাহিনী’ তাঁর যে শ্রেণির রচনা – ছোট গল্প (লেখকের মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার কাহিনী) ।
’সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান’ আবু ইসাহকের যে শ্রেণির রচনা – বাংলা ভাষার অভিধান ।
আবু ইসহাক রচিত ‘ সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান’ ‘অন্ধকার’ শব্দের সমার্থক শব্দ ব্যবহার করেছেন – ১২৭ টি ।
’বারে বা, বড় পাখির বড় রং, আণ্ডা পাড়ার দেখ ঢং, উক্তিটি আবু ইসহাকের যে রচনার – ‘মহাপতঙ্গ’ নামক ছোট গল্পের ।
তাঁর মহাপতঙ্গ গল্পে যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন – একজোড়া চড়ুই পাখির জবানিতে একদিকে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ অন্যদিকে বিজ্ঞানের অভিশাপ ।
’সূর্য-দীঘল বাড়ী’ আবু ইসহাকের যে শ্রেণির রচনা – সামাজিক উপন্যাস ।
ওসমান, তোতা মিয়া, টুনি, করিম গাজী, নবুখা প্রভৃতি যে গল্পের চরিত্র – আবু ইসহাকের ‘জোক’ নামক ছোট গল্পের ।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য আবু ইসহাক যে যে পুরস্কার লাভ করেন – বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯০), একুশে পদক (১৯৯৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর, ২০০৬) প্রভৃতি ।
কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের প্রথম সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় – আবু ইসহাককে ১৯৭৬ সালে ।
স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক ও বিশিষ্ট অভিধান প্রণেতা আবু ইসহাক মৃত্যুবরণ করেন – ২০০৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি (মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবর স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়) ।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) কথাসাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ। ১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক জমিদারবংশে তাঁর জন্ম।
তিনি ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি ছোটোগল্প-সংকলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ-সংকলন, ৪টি স্মৃতিকথা, ২টি ভ্রমণকাহিনি, একটি কাব্যগ্রন্থ এবং একটি প্রহসন রচনা করেন। আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসের জন্য তারাশঙ্কর ১৯৫৫ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার ও ১৯৫৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং ১৯৬৭ সালে গণদেবতা উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া ১৯৬২ সালে তিনি পদ্মশ্রী এবং ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ সম্মান অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।
বাল্যকালে পিতাকে হারিয়ে তিনি মা এবং বিধবা পিসিমার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন। ১৯১৬ সালে স্বগ্রামের যাদবলাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আইএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ সালে তিনি এক বছর অন্তরীণ থাকেন। ফলে তাঁর শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। পরে তিনি পুরোপুরিভাবে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে প্রায় এক বছর কারাবরণ করেন (১৯৩০)। কারামুক্তির পর কিছুকাল গ্রামে কাটিয়ে ১৯৪০ সালে তিনি স্থায়িভাবে কলকাতার বাসিন্দা হন এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
তারাশঙ্করের প্রথম গল্প ‘রসকলি’ সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল-এ প্রকাশিত হয়। এছাড়া কালিকলম, বঙ্গশ্রী, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী, পরিচয় প্রভৃতি প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তবে রাজনীতি থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হননি। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি কিছুকাল কলকাতায় কয়লার ব্যবসা এবং কিছুকাল কানপুরে চাকরি করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সভাপতি নির্বাচিত হন।
প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি। বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের মাটি ও মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনচিত্র, স্বাধীনতা আন্দোলন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ব্যক্তির মহিমা ও বিদ্রোহ, সামন্ততন্ত্র-ধনতন্ত্রের দ্বন্দ্বে ধনতন্ত্রের বিজয় ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্ত্ত।
মানবচরিত্রের নানা জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য তাঁর উপন্যাসে জীবন্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নিজে জমিদারবংশের সন্তান হয়ে কাছ থেকে দেখেছেন কীভাবে জমিদারি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়; পাশাপাশি নব্য ধনিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং দিকে দিকে কল-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তখন একদিকে চলছিল গ্রাম্য সমাজের ভাঙন, অন্যদিকে শহরজীবনের বিকাশ। সমাজের এ নীরব পরিবর্তন তাঁর রচনায় নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তারাশঙ্করের রচনার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য-তিনি পরম যত্নের সঙ্গে মানুষের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের পরে কথাসাহিত্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁদের একজন।
তারাশঙ্কর প্রায় দুশ গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলির মধ্যে চৈতালী ঘূর্ণি (১৯৩২), জলসাঘর (১৯৩৮), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪৩), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), কবি (১৯৪৪), হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক গল্পও লিখেছেন। বেদে, পটুয়া, মালাকার, লাঠিয়াল, চৌকিদার, বাগদী, বোষ্টম, ডোম ইত্যাদি সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র তাঁর গল্পে দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে। ‘রসকলি’, ‘বেদেনী’, ‘ডাকহরকরা’ প্রভৃতি তাঁর প্রসিদ্ধ ছোটগল্প। তারাশঙ্করের গল্পের সংকলন তিন খন্ডে সাহিত্য সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত (১৯৭৭-১৯৭৯) হয়েছে। তাঁর দুই পুরুষ, কালিন্দী, আরোগ্য নিকেতন ও জলসাঘর অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৪৭) ও ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৬) লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৫৫), ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৫৬), ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ (১৯৬৭) এবং ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬২) ও ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক (১৯০৮-১৯৫৬) কথাসাহিত্যিক। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে পিতার কর্মস্থল বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের নিকট মালবদিয়া গ্রামে। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েট। তিনি সেটেলমেন্ট বিভাগে চাকরি করতেন এবং শেষজীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার, ‘মানিক’ তাঁর ডাকনাম।
পিতার চাকরিসূত্রে মানিককে দুমকা, আড়া, সাসারাম, কলকাতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বারাসাত, টাঙ্গাইল ও মেদিনীপুরের নানা স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। শেষপর্যন্ত তিনি মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পাস করেন। পরে বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে আইএসসি (১৯২৮) পাস করে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএসসি-তে ভর্তি (১৯২৮) হন, কিন্তু পাঠ অসমাপ্ত রেখেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করা থেকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সহোদরের সঙ্গে যৌথভাবে ‘উদয়াচল প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস’ পরিচালনা করেন। একইসঙ্গে তিনি বঙ্গশ্রী (১৯৩৭-৩৯) পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়া কিছুদিন তিনি ভারত সরকারের ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের প্রভিন্সিয়াল অরগানাইজার এবং বেঙ্গল দপ্তরে প্রচার সহকারী পদেও কর্মরত ছিলেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক। স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় বিচিত্রা পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ (১৯২৮) প্রকাশিত হলে পাঠক মহলে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। পরে নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের মর্যাদা লাভ করেন। বিশ শতকের তিরিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র ধারার বিরোধিতা করে যে কল্লোল গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে, সেই গোষ্ঠীর লেখক হিসেবে মানিকের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে ওঠে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনের প্রথম পর্বে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার প্রমুখ দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষা নেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন এবং আমৃত্যু এই দলের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। সাহিত্যের মাধ্যমে মার্ক্সের শ্রেণিসংগ্রামতত্ত্বের বিশ্লেষণ এবং মানুষের মনোরহস্যের জটিলতা উন্মোচনে তিনি ছিলেন একজন দক্ষশিল্পী। শহরের পাশাপাশি গ্রামজীবনের দ্বন্দ্বসঙ্কুল পটভূমিও তাঁর উপন্যাস ও গল্পে গুরুত্ব পেয়েছে। অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও দুশো চবিবশটি গল্প তিনি রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গন্থ: উপন্যাস জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), সার্বজনীন (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩) প্রভৃতি; আর ছোটগল্প অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), সরীসৃপ (১৯৩৯), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), হলুদ পোড়া (১৯৪৫), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫০), ফেরিওয়ালা (১৯৫৩) ইত্যাদি। পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাস দুটি তাঁর বিখ্যাত রচনা। এ দুটির মাধ্যমেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পদ্মানদীর মাঝি চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচনায় মানুষের অন্তর্জীবন ও মনোলোক বিশ্লেষণে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রথম দিকের রচনায় নিপুণভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে মানুষের অবচেতন মনের নিগূঢ় রহস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর পরবর্তী রচনায় তাঁর সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নাগরিক জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে তার নিখুঁত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর এ পর্যায়ের রচনায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে চরম দারিদ্রে্যর সম্মুখীন হয়েছেন, তা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যচর্চাকেই পেশা হিসেবে অাঁকড়ে ধরেছেন। এক সময় তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর জন্য সাহিত্যিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। এসব কারণে দারিদ্র্য মানুষের স্বভাবে কী পরিবর্তন আনে, বিশেষত যৌনাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে উদরপূর্তি কী সমস্যার সৃষ্টি করে তার একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গ প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এর যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। দুবার তিনি এ সঙ্ঘের সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে ঐক্য ও মৈত্রী স্থাপনের প্রয়াসে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের গণসাহিত্য শাখায় এবং ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ আয়োজিত জোসেফ স্টালিনের শোকসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু
আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী (২৭ নভেম্বর ১৯২৫ - ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) ছিলেন একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, বাগ্মী এবং বুদ্ধিজীবী। তার রচিত কবর (রচনাকাল ১৯৫৩, প্রকাশকাল ১৯৬৬) পূর্ববাংলার প্রথম প্রতিবাদী নাটক। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম একজন শিকার। তিনি তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন গোপাইরবাগ গ্রামে। তিনি ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। কবীর চৌধুরী তার অগ্রজ, ফেরদৌসী মজুমদার তার অনুজা। ১৯৪৯-এ লিলি চৌধুরীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
জন্ম | আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী ২৭ নভেম্বর ১৯২৫ মানিকগঞ্জ, ব্রিটিশ ভারত |
---|---|
মৃত্যু | ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ (বয়স ৪৬) |
পেশা | নাট্যকার, প্রবন্ধকার |
ভাষা | বাংলা |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয় |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত |
শিক্ষা | এমএ (ভাষাতত্ত্ব) |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় |
উল্লেখযোগ্য রচনা | রক্তাক্ত প্রান্তর, কবর |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২) স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০) |
দাম্পত্যসঙ্গী | লিলি চৌধুরী |
সন্তান | আহমেদ মুনীর আশফাক মুনীর আসিফ মুনীর |
আত্মীয় | ফেরদৌসী মজুমদার (বোন) কবীর চৌধুরী (ভাই) |
ছাত্রজীবনঃ
মুনীর চৌধুরী ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন এবং ১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স (১৯৪৬) এবং মাস্টার্স (১৯৪৭) পাস করেন, উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। বক্তৃতানৈপুণ্যের সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের প্রথম বছরেই, ১৯৪৩ সালে, হলের সেরা বক্তা হিসেবে প্রোভোস্ট্স কাপ জেতেন।
১৯৪৬ সালে নিখিল বঙ্গ সাহিত্য প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক সংখ্যক পুরস্কার জেতেন। ছাত্রাবস্থাতেই এক অঙ্কের নাটক রাজার জন্মদিনে লিখেছিলেন, যা ছাত্র সংসদ মঞ্চস্থ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই মুনীর চৌধুরী বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন, ফলে তার পরীক্ষার ফলাফল এতে ব্যাহত হয়। বামপন্থী রাজনীতিতে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে তাকে সলিমুল্লাহ হল থেকে বহিস্কার করা হয়। একই কারণে পিতার আর্থিক সাহায্য থেকেও তিনি বঞ্চিত হন। এসময় তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্রের জন্য নাটক লিখে আয় করতেন। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে প্রথম ছাত্রসভা হয়, তাতে তিনি বক্তৃতা করেন।
পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কাজঃ
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপরই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির অধীনে পূর্ববঙ্গে (নববগঠিত পূর্ব পাকিস্তান) কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একটি আঞ্চলিক (জোনাল) কমিটি গঠন করা হয়। এই জোনাল কমিটির সাত সদস্যের একজন ছিলেন মুনীর চৌধুরী। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে মুনীর চৌধুরী যোগদান করেন। একই বছরের শেষের দিকে প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন।
শিক্ষকতা পর্বঃ
১৯৪৯ সালে মুনীর চৌধুরী খুলনার ব্রজলাল কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি কিছুদিন বাংলাও পড়িয়েছিলেন। ঐ বছর মার্চে তিনি ঢাকায় এসে রাজনৈতিক তৎপরতার কারণে গ্রেপ্তার হন, তবে রাজনীতি না করার প্রতিশ্রুতিতে ছাড়া পান। একই বছর তিনি লিলি মীর্জাকে বিয়ে করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে যোগ দেন এবং সে বছরই আগস্ট মাসে ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্তি লাভ করেন। কিন্তু রাজনীতি থেকে বেশি দূরে থাকতে পারেন নি। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে পুলিশের ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। ২৬শে ফেব্রুয়ারি শিক্ষকদের প্রতিবাদ সভা আহ্বান করতে গিয়ে গ্রেফতার হন ও তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এসময় প্রায় দুই বছর তিনি দিনাজপুর ও ঢাকা জেলে বন্দী জীবনযাপন করেন। বন্দী অবস্থায় ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি কারাবন্দীদের অভিনয়ের জন্য লেখেন কবর নামের একাঙ্কিকা। ১৯৫৩ সালে বামপন্থী রণেশ দাশগুপ্ত জেলখানাতে ২১ ফেব্রুয়ারি উৎযাপনের লক্ষে মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লেখার অনুরোধ জানান। এই অনুরোধের ভিত্তিতে তিনি ঐ নাটকটি রচনা করেন।[৩] এ নাটকটি তার শ্রেষ্ঠ নাটক হিসেবে খ্যাত এবং এর প্রথম মঞ্চায়ন হয় জেলখানার ভেতরে, যাতে কারাবন্দীরাই বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
সঙ্গী কারাবন্দী অধ্যাপক অজিত গুহের কাছ থেকে তিনি প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন, কারাগারে থেকেই ১৯৫৩ সালে বাংলায় প্রাথমিক এম এ পরীক্ষা দেন ও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৫৪ সালে নিরাপত্তা বন্দী থাকা অবস্থায় এম এ শেষ পর্ব পরীক্ষা দিয়ে তিনি কৃতিত্বের সাথে বাংলায় মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করেন।
১৯৫৪ সালের ১৫ই নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের প্রচেষ্টায় বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং আগস্ট মাসে বাংলা বিভাগে সার্বক্ষণিক চাকুরি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি বাংলার প্রভাষক হিসেবে চাকুরি স্থায়ী করেন। ১৯৫৬ সালের শেষ দিকে রকাফেলার বৃত্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে আরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সে বছর সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬২ সালে অস্থায়ী রিডার পদে নিযুক্ত হন।
১৯৬৯ সালে মুহম্মদ আবদুল হাই অকালে মৃত্যুবরণ করলে তার স্থানে মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হন। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত একটি ভাষাতাত্ত্বিক সম্মেলনে যোগ দিতে যান।
রাজনৈতিক জীবনঃ
মুনীর চৌধুরী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দী হন। বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি তার বিখ্যাত নাটক কবর রচনা করেন (১৯৫৩)। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যে কোন ধরনের সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ১৯৬৬ সালে রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচারে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা বর্ণমালাকে রোমান বর্ণমালা দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে সে আন্দোলনের সমর্থনে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব বর্জন করেন।
বাংলা টাইপরাইটার ও মুনীর অপ্টিমাঃ
মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বাংলা টাইপরাইটারের জন্য উন্নতমানের কী-বোর্ড উদ্ভাবন করেন, যার নাম মুনীর অপ্টিমা। An Illustrated Brochure on Bengali Typewriter (1965) শীর্ষক পুস্তিকায় তিনি তার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন এবং এই নতুন টাইপরাইটার নির্মাণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকবার তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে যান।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানঃ
মুনীর চৌধুরী ১৯৫৩ সালে কারাবন্দী অবস্থায় কবর নাটকটি রচনা করেন। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-সংস্কার কমিটির রিপোর্টের অবৈজ্ঞানিক ও সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তুর তীব্র সমালোচনা করে মুনীর চৌধুরী পূর্ববঙ্গের ভাষা কমিটির রিপোর্ট আলোচনা প্রসঙ্গে একটি দীর্ঘ ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৫৯ সালের ২৭শে এপ্রিল প্রবন্ধটি বাংলা একাডেমিতে পঠিত হয়। কিন্তু মুসলিম ধর্মবিশ্বাসে আঘাতের অভিযোগে সামরিক সরকারের কাছে তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হয়। এরপর তিনি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন ও বেশ কিছু মৌলিক ও অনুবাদ নাটক লেখেন। অনেকগুলি প্রবন্ধের সংকলনও প্রকাশ করেন। মীর মানস (১৯৬৫) প্রবন্ধ সংকলনের জন্য দাউদ পুরস্কার এবং পাক-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে লেখা সাংবাদিকতাসুলভ রচনা-সংকলন রণাঙ্গন (১৯৬৬)-এর জন্য সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বাংলা বর্ণমালা ও বানান-পদ্ধতির সংস্কার প্রচেষ্টার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে প্রবন্ধ লেখেন এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ক বিতর্কে সক্রিয় অংশ নেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মৃত্যুঃ
১৯৭১ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুনীর চৌধুরী ফিরে আসার কিছুকাল পরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার কিশোর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে যায়। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশে মে-জুন মাসে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে এবং জুলাই মাস থেকে কলা অনুষদের ডীন হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সহযোগী আল-বদর বাহিনী তার বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে ও সম্ভবত ঐদিনই তাকে হত্যা করে।
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিঃ
নাটক
রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২): পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের কাহিনী এর মূল উপজীব্য। এতে তিনি যুদ্ধবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেন। নাটকটির জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।
চিঠি (১৯৬৬)
কবর (রচনাকাল ১৯৫৩, প্রকাশকাল ১৯৬৬) পূর্ববাংলার প্রথম প্রতিবাদী নাটক। নাটকটির পটভূমি হলো ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন।
দণ্ডকারণ্য (১৯৬৬): রূপকাশ্রয়ী নাটক।
পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য (১৯৬৯):
মানুষ(১৯৪৭): ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কাহিনী এর মূল উপজীব্য।
নষ্ট ছেলে(১৯৫০): রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ নাটক।
দণ্ডকারণ্য(১৯৬৬): তিনটি নাটকের সমন্বয়। এতে দণ্ড, দণ্ডধর, দণ্ডকারণ্য।
রাজার জন্মদিন(১৯৪৬)
চিঠি(১৯৬৬)
পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য(১৯৬৯)
অনুবাদ নাটক
কেউ কিছু বলতে পারে না (১৯৬৯): জর্জ বার্নার্ড শর You never can tell-এর বাংলা অনুবাদ।
রূপার কৌটা (১৯৬৯): জন গলজ্ওয়র্দির The Silver Box-এর বাংলা অনুবাদ।
মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৭০): উইলিয়াম শেক্স্পিয়ারের Taming of the Shrew-এর বাংলা অনুবাদ।
প্রবন্ধ গ্রন্থ
ড্রাইডেন ও ডি.এল. রায় (১৯৬৩): পরে তুলনামূলক সমালোচনা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত
মীর মানস (১৯৬৫)
রণাঙ্গন (১৯৬৬): সৈয়দ শামসুল হক ও রফিকুল ইসলামের সাথে একত্রে।
তুলনামূলক সমালোচনা (১৯৬৯)
বাংলা গদ্যরীতি (১৯৭০)
অন্যান্য
An Illustrated Brochure on Bengali Typewriter (1965)
১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমি থেকে আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় চার খণ্ডে মুনীর চৌধুরী রচনাবলি প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ডে (১৯৮২) মৌলিক নাট্যকর্ম, দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯৮৪) অনুবাদ নাট্যকর্ম, তৃতীয় খণ্ডে (১৯৮৪) সমালোচনামূলক গ্রন্থাবলি এবং চতুর্থ খণ্ডে (১৯৮৬) ছোটগল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক সমালোচনা ও আত্মকথনমূলক রচনা প্রকাশিত হয়।
পুরস্কার ও সম্মাননাঃ
বাংলা একাডেমি পুরস্কার (নাটক), ১৯৬২
দাউদ পুরস্কার (মীর মানস গ্রন্থের জন্য) ১৯৬৫
সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৬) (মার্চ ১৯৭১ বর্জন করেন)
স্বাধীনতা পুরস্কার (সাহিত্য) ১৯৮০
বাংলাদেশ মুজিবনগর কর্মচারী কল্যাণ সংসদ সম্মাননা স্মারক ১৯৯২
ভাষা সৈনিক ও রাজবন্দী পরিষদ সম্মাননা স্মারক ১৯৯৩
মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক সম্মাননা পরিষদ ১৯৯৬
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালুমনাই অ্যাসোসিয়েশন সম্মাননা স্মারক ২০১৮
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ সম্মাননা স্মারক ২০১৯
অনুসন্ধান ইঞ্জিন গুগল তার ৯৫তম জন্মদিনে তাকে নিয়ে ডুডল দিনব্যাপী প্রদর্শন করে।
Read more